কিংবদন্তির বিদায়…
রুপালি গিটার ফেলে চলে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু
বাংলাদেশে এবং বাংলা ব্যান্ড সংগীতকে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম অগ্রপথিক আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর ২০১৮) সকালে অচেতন অবস্থায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ব্যান্ড দল এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার, প্লেব্যাক শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক।
চার দশক বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখা রকস্টারের বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। গিটার বাদনে তাঁর খ্যাতি ছিল পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই। আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘ফেরারী এই মনটা আমার’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘রুপালি গিটার’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র মতো বহু গান শ্রোতাদের হৃদয়ে বাজবে বহুদিন।
গতকাল সকালে তাঁর মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্বজন, সহশিল্পী, সহকর্মী ও ভক্ত শ্রোতাদের পাশাপাশি সংগীত জগতের অনেকেই ছুটে আসেন হাসপাতালে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, সৌদি আরবে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই এই শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ফেইসবুকে এক পোস্টে কলকাতার শিল্পী অঞ্জন দত্ত লিখেছেন : ‘টেরিবল লস… আইয়ুব বাচ্চু…’। এলারবির সদস্য শামিম বলেন, বাচ্চু বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগের কারণে সপ্তাহ দুই আগেও একবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
মগবাজারের বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে গতকাল সকালে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল ডিরেক্টর ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, জরুরি বিভাগে কার্ডিয়াক কনসালট্যান্ট মুনসুর মাহবুবের উপস্থিতিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে আইয়ুব বাচ্চুর হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে আইয়ুব বাচ্চুকে মৃত ঘোষণা করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মির্জা নাজিমুদ্দিন বলেন, আমরা আইয়ুব বাচ্চুকে মৃত অবস্থাতেই পাই। তার পরেও আমাদের স্পেশাল টিম তাঁকে ফিরিয়ে আনার সব রকমের চেষ্টা করে। তিনি বহুদিন ধরে হৃৎরোগে ভুগছিলেন। তাঁর হার্টে কার্ডিয়োমাইপ্যাথি ছিল। ২০০৯ সালে তাঁর হার্টে একটি স্টেন্ট পরানো হয়। মির্জা নাজিমুদ্দিন জানান, তিন সপ্তাহ আগে আইয়ুব বাচ্চু স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর হৃৎযন্ত্রের কার্যকারিতা ছিল ৩০ শতাংশ, যেখানে একজন সুস্থ মানুষের থাকে ৭০ শতাংশ। এ জন্যই বারবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো। হার্টের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর মুখ থেকে পানির মতো ফেনা বের হচ্ছিল।
গত ১৬ অগাস্ট নিজের জন্মদিনে আইয়ুব বাচ্চু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চার দশকের সংগীত জীবনে তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস, মানুষের ভালোবাসা। বলেছিলেন একটি আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনার কথা। ঈদের পরে কাজটা শুরু করব। ঢাকা ছেড়ে কোথাও চলে যাব যেখানে কোনো ফোন থাকবে না, ইন্টারনেট থাকবে না। নদীর মাছ খাব, ভাত খাব, পানি খাবÑ এমন জায়গায় চলে যাবো। লেখার কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরব। নানা উত্থান, পতন পেরিয়ে জীবনের এই পর্যায়ে এসে জীবন নিয়ে এই শিল্পীর উপলব্ধি ছিল : বহুদূর যেতে হবে। এখনো পথের অনেকটা বাকি। ব্যান্ডতারকা লাবু রহমান বলেছেন, আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একজন শিক্ষক। আমাদের দেশে ব্যান্ডসংগীতে এ রকম শিক্ষক নেই বললেই চলে। তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা সবাই তাঁকে মিস করব।
সাংস্কৃতিক সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার (আজ) সকাল সাড়ে ১০টায় আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। জুমার পর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে হবে জানাজা। তারপর মরদেহ রাখা হবে হিমঘরে। দুই ছেলে মেয়ে বিদেশ থেকে ফিরলে শনিবার (আগামীকাল) চট্টগ্রামে নেওয়া হবে জনপ্রিয় এই ব্যন্ড শিল্পীর মরদেহ। সেখানে আরেক দফা জানাজার পর মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।
বেড়ে ওঠার কথা : লাভ রানস ব্লাইন্ড
আইয়ুব বাচ্চুর ডাক নাম রবিন। জন্ম ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট, চট্টগ্রামে। সেখানেই কেটেছে কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছেলেবেলায় গান শুনতে শুনতে নিজে চেষ্টা করতে গিয়েই তার গায়ক হয়ে ওঠা। পশ্চিমা সংগীতের প্রেমে পড়ে হাত দেন গিটারে। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুরের মত শিল্পীদের কাজ থেকে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে বাচ্চু গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ডদল। শুরুতে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। পাড়া মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের পরিবেশনা। পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে বাচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু ১৯৭৮ সালে। ব্যান্ড দলে ‘ফিলিংস’-এর সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি। সে সময় তিনি এককভাবে প্রথম কণ্ঠ দেন হারানো বিকেলের গল্প শিরোনামের গানে। দুই বছরের মাথায় যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলসে। টানা দশ বছর সোলসের লিড গিটার বাজানোর পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। সে সময় তার সঙ্গী ছিলেন জয়, স্বপন আর এস আই টুটুল। শুরুতে এলআরবির পুরো নামটি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। রাজধানীর মগবাজারে ‘এবি কিচেন’ নামে তার একটি নিজস্ব মিউজিক স্টুডিও রয়েছে।
এলআরবির প্রথম কনসার্ট হয়েছিল ঢাকার একটি ক্লাবে। সেখানে ইংরেজি গানই পরিবেশন করেছিলেন তারা। কিছুদিন পর ঢাকা শিশু একাডেমিতে এক কনসার্টে প্রথমবারের মতো ক্লাব বা হোটেলের বাইরে দর্শকদের সামনে আসে এলআরবি। ১৯৯২ সালে দলের নামেই বাজারে আসে এলআরবির জোড়া অ্যালবাম এলআরবি ১ ও ২। এর পর গত ২৭ বছরে সুখ, তবুও, ঘুমন্ত শহরে, স্বপ্ন, ফেরারী মন, বিস্ময়, যুদ্ধ, স্পর্শসহ ১৪টি অ্যালবাম শ্রোতাদের সামনে এনেছে এলআরবি। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’ বাজারে আসে ১৯৮৬ সালে। তখনও তিনি সোলসে। প্রথম অ্যালবাম খুব একটা সাড়া না-পেলেও ১৯৮৮ সালে ‘ময়না’ অ্যালবামে গায়ক হিসেবে বাচ্চু শ্রোতাপ্রিয় হতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বাচ্চুর তৃতীয় একক অ্যালবাম কষ্ট দারুণ ব্যবসা সফল হয়। পরের বছরগুলোতে ‘সময়’, ‘একা’, ‘প্রেম তুমি কি’, ‘কাফেলা’, ‘পথের গান’, ‘জীবন’, ‘রিমঝিম বৃষ্টি’, ‘বলিনি কখনো’র মতো একক অ্যালবাম নিয়ে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেনে আইয়ুব বাচ্চু। ২০১৫ সালে বাজারে আসে তার একক অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প’। এ ছাড়া লাল বাদশা, গুণ্ডা নাম্বার ওয়ান, ব্যাচেলর ও চোরাবালি সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন বাচ্চু। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান : ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ দারুণ জনপ্রিয় হয়। প্রায় তিন যুগের সংগীতজীবনে আইয়ুব বাচ্চু গানের পাশাপাশি তাঁর গিটারের জাদুতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। যে কোনো স্টেজ শোতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই গায়ক ও সংগীত পরিচালকের গিটারের মূর্ছনা উদ্দীপ্ত করেনি, এমন গানপাগল খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
ফেসবুকে স্মৃতি হয়ে থাকবেন আইয়ুব বাচ্চু
কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে শোকের আবহ নেমে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। বাচ্চুর হঠাৎ চলে যাওয়া কিছুতেই মানতে পরছেন না তার ভক্তরা। এরই মধ্যে আইয়ুব বাচ্চুর প্রোফাইলকে রিমেমবারিং করেছে ফেসবুক। গতকাল দুপুর ১২টার পর বাচ্চুর প্রোফাইলে রিমেমবারিং বা স্মরণীয় বার্তা দেখা যায়। ফেসবুকে আইয়ুব বাচ্চু সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর রাতে রংপুরের একটি কনসার্টের কয়েকটি ছবি আপলোড করেন। যার ক্যাপশনে তিনি লিখেন, Hats off #Rangpur. Love to #GB. Where there are musicians, There are music. See you soon again #Rangpur. Love you. You were awesome tonight. এদিকে, আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন অনেকে। রীভ আল সায়ার নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, আমাকে একটি সুন্দর শৈশব ও তারুণ্য উপহার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ আইয়ুব বাচ্চু। আপনার রুপালি গিটারটার সুর আমার হৃদয়ে ঠিকই থেকে যাবে।
জাতীয় সংগীতের সুরে শেষ হতো তাঁর কনসার্ট
কনসার্টে গাওয়া তাঁর সব গানই ছিল জনপ্রিয়। ছিলেন গিটারের জাদুকর। গিটারের সুরে ‘সেই তুমি’ কিংবা ‘এক পুরুষে গড়ে ধন’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’, ‘এক দিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘সেই তারা ভরা রাতে’, ‘এখন অনেক রাত’সহ আরও অনেক গান গাইতেন তিনি। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে তাঁর গাওয়া এখনকার সব গান তরুণদের মুখে মুখে। কনসার্ট শেষে আইয়ুব বাচ্চুর গিটারে বেজে উঠত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। গিটারটা সোজা করে ধরে মঞ্চের সামনে এসে গিটারে তুলতেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ সুর। সঙ্গে সঙ্গে গোটা কনসার্টের সমবেত মানুষ দাঁড়িয়ে গিয়ে গিটারের সুরের সঙ্গে গলা মেলাতেন। কনসার্টস্থলে তৈরি হতো এক অন্য রকম পরিবেশ। শিল্পী ফাহমিদা নবী বলেন, আইয়ুব বাচ্চুর দেশপ্রেম কতটা প্রবল ছিল, তা বোঝা যায় তাঁর কনসার্ট শেষে। গিটারের সুরে জাতীয়সংগীতকে তিনি নিয়ে গেছেন দেশ-দেশান্তরে। গভীর দেশপ্রেম না-থাকলে একজন শিল্পী বড় হতে পারে না। তাঁর মধ্যে সেই দেশপ্রেম ছিল প্রবল। প্রত্যেকের ভেতর এমন দেশপ্রেম থাকা উচিত। আজ তিনি মারা যাওয়ার পর মানুষ যেভাবে ছুটে এসেছেন, তাতে তাঁর দেশপ্রেমের প্রকাশ পাওয়া যায়। আমি গর্বিত তাঁর মতো শিল্পী আমাদের সময়ে ছিলেন।
-রঙিনদুনিয়া ডেস্ক